এই ব্লগে "শ্রমের মর্যাদা" বিষয়ক একটি রচনা রয়েছে। শ্রমের গুরুত্ব এবং আমাদের জীবনে তার অপরিসীম প্রভাব নিয়ে চিন্তা করার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই রচনা আপনাদের ভালো লাগবে এবং আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
শ্রমের মর্যাদা রচনা ১
ভূমিকা : অলসতার গহিন পাথরে গা ভাসিয়ে না দিয়ে কোনো কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখার নামই শ্রম। প্রাণী মাত্রই কোনো কাজ করে জীবন ধারণ করে। এজন্য মানুষকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। অণু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত, বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে শ্রম। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই পৃথিবীর সব কাজে— খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা যা কিছু আছে সবই অর্জিত হয়েছে শ্রমের দ্বারা। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে—
“মানুষের জন্যে শ্রম ব্যতিরেকে কিছুই নেই।”
জ্ঞানীর জ্ঞান, বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, ধর্মসাধকের আত্মোপলদ্ধি, ধনীর ধনৈশ্বর্য, যোদ্ধার যুদ্ধে জয়লাভ সবকিছুই শ্রমলব্ধ। সুতরাং পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। এবং যথার্থ পরিশ্রমী ব্যক্তি তার জীবনে সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে।তাই কবির ভাষায় বলতে হয়—
“কৃষকের পুত্র কিংবা রাজার কুমার
সবারই রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার।”
শ্রমের গুরুত্ব: মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাণ করে, আর এই ভাগ্যকে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রমের প্রয়োজন। কর্মই সাফল্যের চাবিকাঠি এবং পরিশ্রমই মানুষের প্রকৃত শক্তি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই, কারণ সফলতার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরতে হয়। সুতরাং, এই জগৎ একটি কর্মশালা এবং জীবনের প্রতিটি ধাপই পরিশ্রমের জন্য উৎসর্গীকৃত।
মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব অসীম। পরিশ্রম ছাড়া উন্নতির চিন্তা করা অসম্ভব। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং মর্যাদার শিখরে পৌঁছাতে হলে অপরিসীম পরিশ্রমের প্রয়োজন। শ্রমেই সফলতা, শ্রমেই সুখ, এবং শ্রমই জীবনের মূলমন্ত্র। আমরা সবাই শ্রমসৈনিক। এ কারণেই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন—
.... a hard-working street–cleaner is a better man than a lazy scholar.
কর্মের সুফল : সংসার নামক কর্মক্ষেত্রে নানা পেশার মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত। উদয়াস্ত শ্রম বিলিয়ে মানুষ ঘরে ফেরে ঘর্মাক্ত হয়ে। এ অপমানের নয়, গৌরবের। এ দুঃখবোধের নয়, পরম প্রাপ্তির। কবির ভাষায়—
“চাষি খেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল,
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার।”
কর্মই কর্মীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। কর্মের মধ্যেই তার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। উদ্যোগী পুরুষ সিংহই নির্মাণ করে সুখ–সভ্যতা। পরিশ্রমই খুলে দেয় জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির সিংহদ্বার।
শ্রমের প্রকারভেদ: আমাদের মানব সমাজে শ্রমকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়: কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম। কায়িক শ্রমে দেহের হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্রমের মাধ্যমে কাজ করতে হয়, মানসিক শ্রমে মস্তিষ্কের কার্যক্রম চালানো হয়। দৈহিক শ্রম ও মানসিক শ্রম একে অপরের পরিপূরক; একটি ছাড়া অন্যটির গুরুত্ব কমে যায়।
একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে উভয় ধরনের শ্রমের সমন্বয় অপরিহার্য। কায়িক শ্রমকে প্রাধান্য না দিলে তৃণমূল পর্যায়ে দেশের ভিত্তি শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, মানসিক শ্রমকে গুরুত্ব না দিলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো সুদৃঢ় হওয়া সম্ভব নয়, যা একটি জাতির বা দেশের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই, এ দুটি শ্রমের কোনো একটিকে অবহেলা করলে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
শ্রম ও সভ্যতা : যুগে যুগে মানবসভ্যতার যে ক্রমবিস্তার, শ্রীবৃদ্ধি, তা লক্ষ–কোটি মানুষের তিল তিল শ্রমেই সম্ভব হয়েছে। একুশ শতকের সভ্যতার চরম উন্নতির দিকে তাকিয়ে আমরা মাঝে মাঝে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। সভ্যতার এ চরম বিকাশের মূলে রয়েছে যুগে যুগান্তরের লক্ষ–কোটি মানুষের অফুরন্ত শ্রম। বহু মানব তাদের বহু দিনের শ্রম তিলে তিলে দান করে গড়ে তুলেছে সভ্যতার তিলোত্তমা মূর্তি। তাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় নি। তারা পাহাড় ভেঙে পথ প্রস্তুত করেছে, সেতু বন্ধনে বেঁধেছে নদীর উভয় তটভূমিকে। নির্মাণ করেছে প্রাসাদ অট্টালিকা। ফলিয়েছে সোনার ধান, কেউ বুনিয়েছে লজ্জা নিবারণের বস্ত্র। কেউবা তৈরি করেছে জীবনকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করার নানা দ্রব্যসামগ্রী। সবার পরিশ্রমের যৌথ প্রয়াসে সভ্যতার এ অনবদ্য বিকাশ হয়েছে। সভ্যতা মানুষের পরিশ্রমের সম্মিলিত যোগফল।
বাংলাদেশে শ্রম সম্পর্কে ধারণা : আমাদের দেশে শ্রমবিভাগ ছিল প্রধানত বর্ণগত। এ বর্ণপ্রথা আমাদের শ্রমবিমুখ করে রেখেছে। উচ্চরর্ণের লোকেরা শ্রম বিমুখ থাকবে আর নিম্নবর্ণের লোকেরা সর্বদা কর্মে নিয়োজিত থাকবে— এ জাতীয় চেতনা আমাদের দেশে প্রাচীনকাল হতে চলে আসছে। অবশ্য আশার কথা হচ্ছে আধুনিক যুগের ছোঁয়ায় বর্তমানে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ব্যক্তিগত জীবনে শ্রমচেতনা : আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের ধারণা দৈহিক শ্রম আত্মসম্মানের ক্ষেত্রে হানিকর। কিন্ত এ চেতনা আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং ভ্রান্ত। দৈহিক শ্রম আমাদের আত্মসম্মানের পরিপন্থি নয়, বরং তা সমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রধান উপায়। তাই প্রতিনিয়ত মানুষ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী হয়ে জীবিকা নির্বাহের কঠের প্রয়াস চালাচ্ছে। শ্রমের সাথে আমাদের জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—
“ভদ্র মোরা শান্ত বড় পোষমানা এ প্রাণ
বোতাম আটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।”
জাতীয় জীবনে শ্রমের গুরুত্ব : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে দক্ষকর্মীর হাতে পরিণত করতে পারলে তারা সমস্যা না হয়ে বরং শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। শতকোটি লোকের দেশ চীন তার বিপুল জনসংখ্যাকে পরিণত করেছে উন্নতির হাতিয়ারে। আমাদেরও হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী। উৎপাদন ও বন্টনে মনোদৈহিক শ্রম নিবিড়ভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে ভোগের অধিকার আপনা থেকেই জন্মাবে। জাতীয় জীবনে শ্রমের গুরুত্বকে অস্বীকার করে আধুনিক সভ্য দুনিয়া গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
প্রতিভা বিকাশের হাতিয়ার : পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। মানুষ আজ কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা উন্নতির চরম উচ্চাসনে আরোহন করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য নতুন নতুন শহর ও নগর নির্মাণ করেছে, আবিষ্কার করেছে অনেক যন্ত্র ও যানবাহন। পরিশ্রম ও সাধনার বলেই এসব আবিষ্কারের প্রতিভা সৃষ্টি হয়।
উন্নত দেশে শ্রমের মর্যাদা : বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে শ্রমকে শ্রম হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সেখানে কাজের প্রকৃতি বিচার করে সম্মান আর অসম্মান নির্ধারিত হয় না। অর্থাৎ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, তারা শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তারা আজ শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যায়নের গুণেই উন্নতির সুউচ্চ শিখরে আরোহন করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীন, মিসর, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভূতি দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা আজ উন্নত ও সুসভ্য জাতি হিসেবে খ্যাত। তাই তারা শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করে।
উপসংহার : প্রতিটি জাতির সম্মান তাদের শ্রমদানে নিহিত। শ্রমের মহিমা ও গৌরব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরাজমান। সব কাজের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পরিশ্রম। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত সমাজ কর্মবিমুখ। আমাদের এই চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করতে হবে। এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, “শ্রম মানেই সাফল্য”।
শ্রমেই শক্তি, শ্রমেই সমৃদ্ধি, শ্রমেই প্রকৃত সাফল্য। পরিশ্রমই জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জীবনটাকে সুখময় করতে হলে, জীবনের প্রকৃত সাফল্যকে পেতে হলে কর্মের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এবং পরিশ্রমই জীবনের সার্থকতা।
শ্রমের মর্যাদা রচনা ২
ভূমিকা : শ্রমই বর্তমান দুনিয়ায় সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার। বিশ শতকের সমাপ্তিতে সভ্যতার এ চরম সমুন্নতির দিকে তাকিয়ে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। সভ্যতার এ চরম বিকাশের মূলে রয়েছে যুগ-যুগান্তরের লক্ষ কোটি মানুষের অক্লান্ত শ্রম। মানুষ তার শ্রমে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এ তিলোত্তমা ভুবন।
তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেক মানুষকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় এবং এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রধান হাতিয়ার হলো পরিশ্রম। সভ্যতার আদি পর্ব থেকে চলমান এ যুদ্ধে মানুষ প্রতিনিয়ত আপন শ্রম ও সাধনায় জয়ী হয়ে অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। মানুষ জানে, শ্রমই হচ্ছে অমরতা অর্জনের প্রধান সোপান।
পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা: মানবসভ্যতার প্রতিটি স্তরে শ্রমের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। প্রাচীন যুগে মানুষ কায়িক এবং মানসিক শ্রমের মাধ্যমে তীর ও নৌকা চালানো শিখেছে এবং পশু শিকার করে মাংস আহরণ করেছে। সভ্যতার কৈশোরে তারা কৃষিকাজে হাত দেয়, এরপর প্রাসাদ নির্মাণ, নগর পত্তন এবং পথঘাট তৈরি করে। আধুনিক যুগে মানুষ মানসিক এবং কায়িক শ্রমের মাধ্যমে সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছে।
শ্রমের প্রকারভেদ: শ্রম মূলত দুই ধরনের। কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম। মানবসভ্যতার বিকাশে এ উভয় প্রকার শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য। উভয় প্রকার শ্রমই সুফল বয়ে আনে। জগতের সুখ-শান্তি, ঐশ্বর্য, সম্মান, প্রতিপত্তি সবকিছু এ শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবস্থাপনাবিদদের পরিশ্রম মূলত মানসিক।
তবে তাদের এ মানসিক শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে তারা কায়িক শ্রমেও অংশগ্রহণ করেন। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে না হলেও তাদের কায়িক শ্রম অবহেলার নয়। রুটিনমাফিক নিয়মিত কায়িক শ্রমে অংশ নেয় সমাজের কুলি-মজুর, শ্রমিক প্রভৃতি সাধারণ জনগণ। অর্থ ও সামাজিক পদমর্যাদা তাদের কম কিন্তু সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদেরই ঘামে, রক্তে তথা শ্রমে।
শ্রমের সুফল: বস্তুত কারো শ্রম বিফলে যায় না। অন্যদিকে শ্রম ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা জাতি উন্নতি করতে পারে না। হযরত মুহম্মদ (স.) হেরা পর্বতের গুহায় রাত-দিন অতিবাহিত করেছেন। সেখানে তাঁর দৈহিক ও মানসিক শ্রম ছিল বিস্ময়কর। সাধারণ সৈনিক থেকে নাসির শাহ হয়েছিলেন সম্রাট। দাস কুতুবুদ্দিন হয়েছিলেন দিল্লির সুলতান আর ঈশ্বরচন্দ্র হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
শ্রমের গুণে আহমেদাবাদ টেক্সটাইল মিলের সামান্য শ্রমিক থেকে স্বাধীন ভারত গড়ার অন্যতম কারিগর হয়েছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। শ্রমের গুণেই বোম্বাই আদালতের সাধারণ আইনজীবী মুহম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রমের এরূপ উৎকৃষ্ট উদাহরণ অজস্র আছে। মূলত অসাধারণ সাফল্যের জন্য অবশ্যই কঠোর শ্রমের দরকার। এ জন্যই প্রবাদ আছে—
“পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি।”
শ্রমের অবমাননা: শ্রম সম্মান হানিকর নয়। শ্রমকে অস্বীকার করা মানেই নির্মল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা এবং নিজেকে শয়তানের দোসরে পরিণত করা। একমাত্র শ্রমেই চিত্তশক্তি এবং আত্মার জাগরণ নিহিত। অথচ আমাদের দেশে কায়িক শ্রমকে আজও অমর্যাদাকর বিবেচনা করা হয়। ফলে ক্রমশ আমরা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি। সর্বাধিক, পার্থিব উন্নতি মূলত শ্রম সামর্থ্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। কায়িক শ্রম আত্মসম্মানের পক্ষে বিন্দুমাত্র হানিকর নয় বরং মানবসমাজে উন্নতির শ্রেষ্ঠ উপায়।
জাতীয় জীবনে শ্রমের মর্যাদা: আমরা স্বাধীন বাংলা দেশের নাগরিক। দেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত। জাতির এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা। লক্ষ করলে দেখা যায় ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা, জাপান, উন্নতির মূলে আছে কঠোর পরিশ্রম। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে শ্রমের মূল্যায়ন করা জরুরি।
উপসংহার: যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। শত শত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপরে শ্রমিক সমাজ সভ্যতার বেদিমূলে অকাতরে, তাদের শ্রম ঢেলে দিয়ে নীরবে কাজ করে এসেছে। তাদের কর্মের জয়োল্লাসে মুখরিত পৃথিবীর পথ-প্রান্তর। কিন্তু তারা, যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
আজ পৃথিবীতে নবযুগ এসেছে। তাই বৃথা আভিজাত্যের ভাব ত্যাগ করে শ্রমকে মর্যাদার বস্তু বলে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মানুষকে স্মরণ রাখতে হবে একমাত্র শ্রম-সাধনার মাধ্যমেই মানুষ এ বিশ্বে নিজ ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে।
শ্রমের মর্যাদা রচনা ৩
(একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো)
ভূমিকা : মানুষের সমস্ত সম্পদ এবং মানব সভ্যতার বুনিয়াদ রচনা করেছে যে শক্তি তার নাম শ্রম। একদিন প্রকৃতির কোলে পাওয়া পাথরের নুড়ি দিয়ে শ্রমের সাহায্যে মানুষ হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল। তাপর প্রায় ৬ লাভ বছর ধরে লাখ কোটি মানুষের তিল তিল শ্রমে গড়ে উঠেছে সভ্যতার বিরাট সৌধ। শুধু তাই নয়, শ্রমের কল্যাণেই মানুষ পশু জগৎ থেকে নিজেকে পৃথক করেছে। শ্রমের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানুষের হাত সাধারণ শ্রম থেকে শুরু করে জটিলতম কাজ সম্পাদনের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। মানুষের হাত যে আধুনিক যন্ত্র, সূক্ষ্ম কারুকাজময় ছবি কিংবা অপরূপ সংগীত লহরী সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছে, তার মূলে রয়েছে শ্রমের অবদান। এককথায় বলা যায়, মানুষের জীবন ও সভ্যতা হচ্ছে শ্রমেরই ফসল, শ্রমেরই কাব্য।
শ্রমের মহিমা : শ্রম যে শুধু সকল সমৃদ্ধির উৎস তা নয়। শ্রম মানুষকে দেয় সৃজনের আনন্দ। প্রত্যেকটি মানুষ কিছু-না-কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু পরিশ্রম ছাড়া সেই প্রতিভা বিকশিত হতে পারে না। পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্যকে গড়ে তোলে। পৃথিবীতে যা-কিছু স্মরণীয়-বরণীয় তার মূলে রয়েছে শ্রমের অবদান। আর যেসব লোক বিশ্বের মানুষের ভালবাসায় মহীয়ান হয়ে আছেন কাঠোর পরিশ্রমই তাঁদেরকে সেই মহিমা দিয়েছে।
সমমান ও মর্যাদাসম্পন্ন দৈহিক ও মানসিক শ্রম : মানব ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষ যখন উদ্বৃত্ত শ্রম উৎপাদন করতে শিখল তখন একদল পরজীবী শ্রেণির সৃষ্টি হলো। নিজেরা শ্রম না করে অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে বিলাস-বাসনে তারা দিন কাটানোর সুযোগ পেল। এভাবে শ্রমের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হলো সামাজিক অসাম্য। মজুর-চাষি-মুটে-কুলি – যারা কায়িক শ্রম করত তারা পড়ে রইল সমাজের নিচের তলায়। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন মানবেতর জীবন হলো তাদের নিত্য সঙ্গী। সমাজে শ্রমজীবী মানুষের এই নিদারুণ অবস্থাই মানুষের মনে শ্রমবিমুখতার জন্ম দিয়েছে। কায়িক শ্রমের প্রতি সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অবজ্ঞা ও ঘৃণার মনোভাব।
আমাদের দেশেও শ্রমজীবীরা সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। ফলে যে মজুর জুতো থেকে শুরু করে বোতাম পর্যন্ত সমস্ত প্রয়োজনের সামগ্রী ও বিলাসদ্রব্য জোগায়, যে কৃষক আমাদের অন্ন জোগায়, তারা সমাজে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে আছে। এভাবে আমরা শ্রম ও শ্রমজীবীকে অবজ্ঞা করছি। এর ফল কল্যাণকর হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ যোগ্যতা ও শক্তি অনুসারে সমাজের সেবা করছে। কোনোটা দৈহিক শ্রম, কোনোটা মানসিক শ্রম। তাই কোনোটিকেই অবহেলা করা বা ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
শ্রমের গুরুত্ব : জীবনযাত্রার জন্যে, সমাজ ও জাতির জন্যে শ্রম এক অপরিহার্য উপাদান। একথা স্বীকার করে নিয়ে সমাজে অবশ্যই শ্রমকে যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। একটা গাছের শিকড়, পাতা, শাখা-প্রশাখা, ফল-ফুল সবার কাজ আলাদা কিন্তু সবটা মিলিয়েই গাছের পূর্ণতা বা বৃদ্ধি। তেমনি সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত লোকের শ্রমে পার্থক্য থাকলেও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কোনোটির গুরুত্ব কম নয়- তা সে দৈহিক শ্রমই হোক কিংবা মানসিক শ্রমই হোক। মজুর এবং ম্যানেজার, কৃষক এবং কৃষি অফিসার, কুলি এবং রাষ্ট্রনায়ক, শিক্ষক এবং শিল্পী কারো কাজই সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রত্যেকটি লোক যথাযথভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলেই সমাজের অগ্রগতি সাধিত হয়। একথা মনে রেখে সবাইকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, “...... a hard-working street-cleaner is a better man than a lazy scholar.”
শ্রমজীবীদের প্রতি সমাজের উপরতলার মানুষের অবহেলা ও অবজ্ঞা দেখে একালের কবি উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেন, ‘আমি কবি যত কামারের, মুটে মজুরের আমি কবি যত ইতরের।’
মানুষ মরণশীল প্রাণী কিন্তু কর্মের মাধ্যমেই সে অমর হতে পারে। আজকের মানুষের কর্মই আগামী দিনের মানুষের নতুন কর্মে উজ্জীবিত করে, নতুন কল্যাণ নতুন অগ্রগতি সাধনে ব্রতী করে। তাই মানুষ কেবল জীবন যাপনেই বাঁচে না, শ্রমের শক্তিতেই বাঁচে। আর শ্রমই মানুষকে করে তোলে অমর। তাই প্রখ্যাত লেখক মাক্সিম গোর্কি বলেছেন – ‘শ্রম ও সৃজনের বীরত্বের চেয়ে গরীয়ান আর কিছু দুনিয়ায় নেই।’
উপসংহার: শতাব্দী প্রভৃত্তির পর বিশ শতকে শ্রমজীবী মানুষের সামনে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। সমাজের উচ্চতলার মানুষ মেহনতি মানুষের মর্যাদা দিতে বাধ্য হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য অনেক দেশে শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায়। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ক্রমাগত স্বীকৃতি পাচ্ছে। ভারতে শ্রমের ভিত্তিতে যে জাতিভেদ ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে। আমাদের দেশে, যে যেখানে আছেন, সমাজ এবং দেশের জন্য নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যত বেশি পরিশ্রম করবেন, দেশের অগ্রগতি ততটাই নির্ভর করবে। যে কোনো ধরনের শ্রমে নিয়োজিত সবাই যদি তাদের দায়িত্ব পালন করে এবং সবার শ্রমকে সমান মর্যাদা দেয়, তবেই দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হবে। মনে রাখতে হবে, আমার শ্রম সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়— এই বোধ মানুষকে মহান করে।
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]
শ্রমের মর্যাদা রচনা ৪
সূচনা : শ্রম মানুষের জীবনের সাথে একান্তভাবে জড়িত। শ্রম ছাড়া দেশ, জাতি বা সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আছে – শ্রম ব্যতীত মানুষের জন্য কিছুই নেই। সুতরাং, মানুষের জীবনে যে কোন কিছুর জন্যই প্রয়োজন শ্রম।
শ্রমের প্রয়োজনীয়তা : পরিশ্রম না করলে কোন কিছুই পাওয়া যায় না। এই শ্রম শারীরিক বা মানসিক উভয় প্রকার হতে পারে। কৃষক কষ্ট করে জমি চাষ করে ফসল ফলাচ্ছে, জেলে জাল ফেলে, তাঁতি কাপড় বুনছে, মিস্ত্রি ঘরবাড়ি ও জিনিসপত্র তৈরি করছে। এদের সবার শ্রম হচ্ছে শারীরিক শ্রম। আবার শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিক এদেশ শ্রম হচ্ছে মানসিক। এই দু প্রকার শ্রমের বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি আমাদের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। আরও পাই ভদ্র ও উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ- মানুষের মত মানুষ হবার সুযোগ। আবার শুধু খাদ্য, বস্ত্র বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্যই নয়, সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্যও শ্রমের প্রয়োজন। পরিশ্রমের ফলে হজম শক্তি ও ক্ষুধা বাড়ে শরীর দৃঢ় ও সবল হয়। তাই শ্রমকাতর ব্যক্তির চেয়ে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
শ্রমের সুফল : শ্রম মানবজাতির উন্নতির মূল। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়। চুপচাপ বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও এক সময় শেষ হয়ে যায়। আবার পরিশ্রম করলে ভিখারীও রাজার সম্পদের অধিকারী হতে পারে। বর্তমানে আমরা বিজ্ঞানের এক চরম উন্নতির যুগে বাস করছি। এর মূলে রয়েছে বৈজ্ঞানিকদের অসংখ্য আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তাঁদের পরিশ্রমের ফলেই। যে জাতি যত পরিশ্রমী সে জাতি ততই উন্নত। অতীতের ও বর্তমানের ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।
পরিশ্রমের মহিমা: এই পৃথিবী কর্মের মঞ্চ। এখানে যার কাজ যেমন, তার ফলও সে তেমনই পায়। আল্লাহ আমাদের কর্মী হিসেবে উপযুক্ত করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এই উন্নতির চূড়ায় পৌঁছেছে। আল্লাহ পরিশ্রমী মানুষকে ভালোবাসেন। তাই পরিশ্রমই মানুষকে সম্মানিত করে।
শ্রমের অবমাননা : কেউ কেউ শ্রমকে ঘৃণা করে থাকে। এতে তারা নিজেরাই অমর্যাদিত হয়। পরিশ্রম ছাড়া আল্লাহর রহমত লাভ করা যায় না। কেউ ঘুমিয়ে বসে থাকলে অন্যের দয়া ছাড়া তার চলার উপায় থাকে না। আবার ইবাদতও এক ধরনের শ্রম। আল্লাহ আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “তোমরা নিজেদের কষ্ট দ্বারা আমাকে লাভ কর।”
উপসংহার : শ্রম ছাড়া মানুষ কিছুই পায় না। কিন্তু আমরা শ্রমকে অবহেলা করে নিজেদের পতন ডেকে আনছি। শ্রমের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেবার জন্য আমাদের সব সময় সচেষ্ট থাকা উচিত। তাহলে দেশ ও জাতির গৌরব বাড়বে – বাড়বে সারা বিশ্বে আমাদের মর্যাদা।
এই রচনা পাঠ শেষে শ্রমের মূল্য সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আরও সমৃদ্ধ হবে। আরও রচনা পড়তে চাইলে, আমাদের ওয়েবসাইটে আরও চমৎকার রচনা রয়েছে। দয়া করে studytika.com আরও রচনা পড়ে দেখুন।
শ্রমের মর্যাদা রচনা ক্লাস 5, শ্রমের মর্যাদা রচনা pdf, শ্রমের মর্যাদা রচনা class 7,শ্রমের মর্যাদা রচনা ক্লাস ১০, শ্রমের মর্যাদা রচনা ক্লাস 8, শ্রমের মর্যাদা রচনা ২০ প্যারা, শ্রমের মর্যাদা রচনা সহজ, শ্রমের মর্যাদা রচনা ক্লাস 6